বদলে যাচ্ছে ক্ষুদ্রঋণের পরিচয়

বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পাওয়া দেশের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম সময়ের বাস্তবতায় এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। জীবনযাত্রার মান ও ব্যয় অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং ধারাবাহিক ঊর্ধ্বগতির মূল্যস্ফীতির কারণে এই সামান্য ঋণ নিয়ে কারবার করতে প্রান্তিক পর্যায়ের একেবারে অসচ্ছলরাও তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। কারণ, ৫-১০ হাজার কিংবা ২০-২৫ হাজার টাকার এই ঋণে এখন কোনো ব্যবসায়িক উদ্যোগই সফল করা যাচ্ছে না। অর্থাৎ দেশে এই ক্ষুদ্রঋণের প্রয়োজনীয়তা প্রায় ফুরিয়ে আসছে।

সবার প্রয়োজন আরও বেশিহারের ঋণ। কিন্তু সারা দেশে প্রান্তিক পর্যায়ে বিভিন্ন ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের ঋণের বড় অংশই ৫০ হাজার টাকার নিচে সীমাবদ্ধ। তা ছাড়া ক্ষুদ্রঋণের সুদ বেশি। এর বিপরীতে ব্যাংকগুলো এখন সেবা নিয়ে যাচ্ছে প্রান্তিক মানুষের কাছে। দিচ্ছে প্রশিক্ষণও। সব মিলে ক্ষুদ্রঋণের দেশীয় বাস্তবতা উপলব্ধি করেছে এর তদারককারী সংস্থা ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ বা মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটিও (এমআরএ)।

এমন আরও অনেক বিষয় আমলে নিয়ে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ (এমআরএ) এখন এ-সংক্রান্ত আইন ও বিধিমালার পরিবর্তন বা সংশোধনী আনতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে তার খসড়াও প্রস্তুত করা হয়েছে।

এই খসড়া পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বাস্তবতার মুখে এখন ক্ষুদ্রঋণের বর্তমান পরিচিতিই পাল্টে ফেলা হচ্ছে। মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি আইন, ২০০৬-এর সংশোধনের মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণের ‘ঋণ’ বা মাইক্রোক্রেডিটের ‘ক্রেডিট’ শব্দটিই উঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এর পরিবর্তে যুক্ত করা হচ্ছে ক্ষুদ্র অর্থায়ন বা মাইক্রোফিন্যান্স কার্যক্রম। একইভাবে ক্ষুদ্রঋণ তদারক প্রতিষ্ঠান মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) বা ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের নামও বদলে ফেলা হচ্ছে। অর্থাৎ মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির জায়গায় নতুন নাম দেওয়া হচ্ছে মাইক্রোফিন্যান্স রেগুলেটরি অথরিটি বা ক্ষুদ্র অর্থায়ন নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ। আইনের পুরো খসড়া পর্যালোচনা করে আরও দেখা গেছে, যেখানে যেখানে ‘ক্ষুদ্রঋণ’ বা ‘মাইক্রোক্রেডিট’ শব্দ রয়েছে, সংশোধিত খসড়ায় তা ছেঁটে ফেলে ক্ষুদ্র অর্থায়ন বা মাইক্রোফিন্যান্স শব্দ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। উদ্দেশ্য হলো এমআরএর নিয়ন্ত্রণে থাকা সারা দেশের প্রায় ১ হাজার ২০০ ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে আরও বেশি আকারে ঋণ দেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতি পেয়ে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের আইন সংশোধনের এমন প্রস্তাব করেছে। একইভাবে এ-সংক্রান্ত বিধিমালারও অনেক পরিবর্তন আনা হয়েছে। যার খসড়াও প্রস্তুত হয়েছে। বর্তমানে খসড়া দুটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে।

সংশোধিত আইন ও বিধিমালার ওপর এখন বিভিন্ন অংশীজনের মতামত নেওয়া হবে। এরপর তা পূর্ণাঙ্গ খসড়া প্রস্তুত করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে উপস্থাপন করা হবে। এরপর ভোটিং শেষে সেটি জাতীয় সংসদে বিল আকারে ওঠানো হবে। সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী জুনের বাজেট অধিবেশনেই বিলটি পাস করার পরিকল্পনা এবং তা রাষ্ট্রপতির সম্মতির মাধ্যমে গেজেট জারি করে সংশোধিত আইনে পরিণত করা হবে।

অসচ্ছলদের খুব অল্প টাকা ঋণ দিয়ে সেটি অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক কোনো খাতে ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যমে যে আয় মিলে, সাপ্তাহিক বা মাসিক কিস্তিতে সুদসহ তার অংশ বিশেষ ফেরত নেওয়ার রীতিই হলো ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম।

জানা গেছে, সময়ের বাস্তবতায় এখন ক্ষুদ্রঋণের প্রয়োজনীয়তা কমে এলেও এতদিন দেশে ক্ষুদ্রঋণই সামাজিক ও পারিবারিক অর্থনীতিতে বিপ্লব ঘটিয়েছে। এর আওতাভুক্ত হাজারো ব্যক্তি ও পরিবার এ ক্ষুদ্রঋণে পেয়েছে স্বনির্ভরতা। একইভাবে সারা দেশে অসংখ্য ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারও সৃষ্টি করেছে এই ক্ষুদ্রঋণ, যা মোট দেশজ উৎপাদনেও (জিডিপি) একটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে। তবে এত ভালো খবরের ভিড়েও দেশে এ ক্ষুদ্রঋণের অনেক অপব্যবহারও এরই মধ্যে হয়েছে। অস্বাভাবিক সুদহার এবং ঋণ প্রদানকারীকে তা লাভজনক খাতে ব্যবহার শেখানোর চেয়ে বিতরণকৃত ঋণের টাকা ফেরত নেওয়ায় তোড়জোড়ও দেখা গেছে। ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের এ ধরনের উদাসীনতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাবে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে অনেক পরিবার কিংবা ব্যক্তি পথেও বসেছে। সব মিলেই এখন ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের খোলনলচে বদল হতে যাচ্ছে।

ক্ষুদ্রঋণের আইন ও বিধিমালার সংশোধন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) এক্সিকিউটিভ ভাইস চেয়ারম্যান মো. ফসিউল্লাহ কালবেলাকে জানান, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান বললে বোঝায় যে, এটা শুধু ক্ষুদ্রঋণ নিয়েই কাজ করে। কিন্তু সময়ের পরিবর্তন হয়েছে। ক্ষুদ্রঋণের কার্যক্রম অনেক বিস্তৃত হয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতা বেড়েছে। সদস্য গ্রাহকদেরও অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি ও গ্র্যাজুয়েশন হওয়ার ফলে ঋণগ্রহীতাদের মধ্য থেকে একটা বড় অংশ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সৃষ্টি হয়েছে। যারা এখন ১০-২০ লাখ টাকা নিচ্ছে। ওই অর্থ বিভিন্ন উদ্ভাবনী প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে। এতে করে এই ক্ষুদ্র উদ্যোগ অনেক মজুরিভিত্তিক কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে এখন আমরা শুধু ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমেই সীমাবদ্ধ নেই। থাকতেও চাই না। এখন ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো সঞ্চয়ও নিচ্ছে, সঞ্চয় রাখছে এবং তার বেনিফিটও দিচ্ছে। এখন মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির এখন এজেন্ট ব্যাংকিং করার সক্ষমতা হয়েছে। প্রবাসীরা বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স পাঠালেও সেটি আমরা দিচ্ছি।

এক প্রশ্নের জবাবে মো. ফসিউল্লাহ আরও জানান, সামাজিক উন্নয়নেও কাজ করছে এমআরএ। যেমন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত। দেশে এমন অনেক হাসপাতাল রয়েছে, যেটি ক্ষুদ্রঋণে গড়ে ওঠা। কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেছে—যেগুলো শিক্ষার প্রসারে কাজ করছে। পাশাপাশি এমআরএর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শিক্ষাবৃত্তি চালু হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রতি বছর পাবলিক বিশ্বদ্যিালয়ের ১ হাজার ২০০ মেধাবী ছেলে-মেয়েকে প্রতি মাসে ৩ এবং ৫-৮ হাজার টাকা পর্যন্ত মাসিক বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। এ কাজগুলো ক্ষুদ্রঋণের মধ্যে পড়ে না। যখন আইনটি করা হয়েছে, তখন ক্ষুদ্রঋণের এত বিস্তৃত কার্যক্রম ছিল না। এখন যেহেতু হচ্ছে, তাই আইন সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব হচ্ছে। আমরা চাই, এমআরএর আওতাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো যাই-ই করুক, সেটি আইনের মধ্য থেকে করুক। তা ছাড়া এখানে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিরও অনেক বিষয় দাঁড়িয়ে গেছে, যা বর্তমান আইনে তার কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। তাই বাস্তবতার নিরিখেই এই আইন ও বিধিমালার সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়া প্রস্তাবিত খসড়া আইন পর্যালোচনায় আরও দেখা গেছে, রেগুলেটরি অথরিটির নিয়ন্ত্রণের ধরনেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। বর্তমান আইনে কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে এক্সিকিউটিভ ভাইস চেয়ারম্যান বলা হয়। সংশোধিত আইনে ‘ভাইস’ শব্দটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের পরিচিতি হবে এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান হিসেবে। একইভাবে এমআরএ পর্ষদের সচিবের পরিচিতি মিলবে পর্ষদে সাচিবিক নাম হিসেবে। আর পরিচালনা পর্ষদের পরিচিতি হবে সাধারণ পর্ষদ হিসেবে।

আর বিধিমালার সংশোধনীতে বলা হয়, এমআরএর আওতাভুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠানের সনদ বাতিল হলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করতে পারবেন, যা কর্তৃপক্ষের পরিচালনা বোর্ড তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবে। এ ছাড়া পরিচালনা পর্ষদে কোনো মেয়াদে সদস্যের সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশের বেশি পরিবর্তন করা যাবে না। এ ছাড়া সংশোধিত বিধিমালায় এমআরএ কর্তৃপক্ষের ক্ষমতাও বাড়ানো হয়েছে। কোনো ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের স্থায়ী পদে এমআরএ কোনো কর্মকর্তাকে এক বছরের জন্য পর্যবেক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে পারবে। আর এখন থেকে কর্তৃপক্ষ নিজেই নিজের বাজেট তৈরি করবে পারবে। তবে সেটি সাধারণ পর্ষদ সভায় অনুমোদন করিয়ে নেবে।

Scroll to Top